তুলশীমালার সেতু বন্ধন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভারতের সীমান্ত ঘেসা শেরপুর জেলার রাংটিয়া গ্রামে বাস করে সানজিদা জেরিন। সে এবার ডিগ্রী ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। তার বাবা একজন কৃষক। গ্রামের মানুষ মনে করে মেয়েরা এসএসসি পরীক্ষা দিলেই অনেক বড় হয়ে যায়। তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে হয়। জেরিন কেউ প্রতিনিয়ত এই সমালোচনার শিকার হতে হয়। কিন্তু জেরিনের ইচ্ছা সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। পাড়া প্রতিবেশী অবশ্য মাঝে মাঝেই জেরিনের বাবাকে বলে যোগ্য একটি ছেলে দেখে জেরিনকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। পরামর্শ দেয় তোমার জমি জমা আছে পারলে কিছু লিখে দাও, তাহলেই যোগ্য পাত্র পেয়ে যাবে। কিন্তু জেরিন তার বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে মেয়েকে যোগ্য না করে যোগ্য পাত্র দেখে বিয়ে দিলে সুখী নাও হতে পারে।
আমাদের সমাজের একটি প্রবণতা হলো মেয়ে যোগ্য না করে যোগ্য পাত্র খোঁজা। একবারও আমরা ভাবি না আল্লাহ না করুক, কোন কারণে সে যোগ্য পাত্র মারা গেলে বা অ্যাক্সিডেন্ট করে পুঙ্গ হলে তখন সে মেয়েটি কি করবে। এমনও তো হতে পারে সে যোগ্য ছেলেটি অযোগ্য মেয়েটিকে অবমূল্যায়ন করতে পারে। সারা জীবন তাকে কষ্ট দিয়ে তার মত যোগ্য আরেকটি মেয়ের সাথে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখতে পারে। কিন্তু যোগ্য জামাই না খুঁজে যদি নিজের মেয়েকে যোগ্য করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে যে কোন পরিস্থিতিতে সে সংসারের হাল ধরতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে জেরিনের মাথায় একটি আইডিয়া আসে। অনেকেই অনলাইনে অনেক কিছু বিক্রি করে। সে ইচ্ছা করলে তাদের জমিতে যে তুলশীমালা ধানের চাষ করা হয়, সে চাল অনলাইনে বিক্রি করতে পারে। এতে করে তার বাবা তুলশীমালা ধানের প্রকৃত মূল্য পাবে, অপরদিকে শেরপুর জেলার ব্র্যান্ড তুলশীমালার প্রকৃত চাল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়ে নিজ জেলা শেরপুর এর সুনাম বয়ে আনতে পারে। তাই তার বাবার সাথে পরামর্শ করে, এবার তুলশীমালা ধান আর কম দামে বিক্রি করবে না। চাল তৈরি করে অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করবে।
প্রযুক্তি জ্ঞানহীন তার কৃষক বাবা কিছুতেই রাজি হতে চায় না। তুই মেয়ে মানুষ বাড়িতে বসে কিভাবে চাল বিক্রি করবি। আমরা বাজারে সারাদিন বসে থেকে বিক্রি করতে পারি না। অবশেষে জেরিন তার বাবাকে অল্প চাল তৈরি করার শর্তে রাজি করায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পেজ খুলে প্রচার করতে থাকে। এক সপ্তাহ পর একটি ৫ কেজি চালের অর্ডার পায়। তারপর দিনকে দিন তার ওর্ডারের পরিমাণ বাড়তেই থাকে।
একদিন তার কমেন্ট বক্সে দেখে জাহিদ নামে এক ছেলে ভুয়া চাল হিসেবে কমেন্ট করে। জেরিন তার প্রতিত্তোর বলে, আপনার বিশ্বাস না হয় ঠিকানা দিন, আমি এক কেজি চাল আপনার ঠিকানায় ফ্রি পাঠাবো। যদি খেয়ে ভালো লাগে তাহলে টাকা বিকাশে পাঠাবেন। পরের সপ্তাহে জাহিদ আরো ৫ কেজি চালের অর্ডার করে এবং মাঝে মাঝে আত্মীয়-স্বজনের জন্যও অর্ডার দেয়। মোবাইল ফোনে কথোপকথনের একপর্যায়ে দুজন দুজনকে জানার চেষ্টা করে।
-হ্যালো, কেমন আছেন আপু?
-ভালো, আপনি কেমন আছেন। আজ কত – -কেজি চাল পাঠাবো?
-কেন, ফোন দিলেই চাল কিনতে হবে?
-তা বলছি না।
-আপনার পড়াশোনা কি শেষ?
-না, ডিগ্রী ফাইনাল দিয়েছি। আপনি?
-আমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি।
-ভালো, আর আমি একজন বেকার মানুষ তাই কিছু করার চেষ্টা করছি।
-আমার মনে হয় আমার চাকরির চেয়ে আপনার মাসিক আয় বেশি। অনেক অর্ডার আর স্বাধীন ভাবে বাড়িতে বসে থেকে ইনকাম।
-নদীর ওপার করে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস ওপারেতে…
এভাবে চলতে চলতে এক পর্যায়ে দুজন দুজনকে পছন্দ করে ফেলে। জাহিদ কে বলে তার বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসার জন্য। জাহিদ তার বাবাকে নিয়ে জেরিনকে দেখতে আসে। জাহিদের বাবা জালাল মিয়া ওরফে খেজুর জালাল বললে এলাকার সবাই তাকে চেনে। কারণ এই এলাকার জালাল মিয়াই প্রথমে উন্নত জাতের খেজুর চাষ শুরু করে এবং সফলতাও পায়। বর্তমানে সে খেজুর ছাড়াও সুপারি ও উন্নত জাতের নারিকেলের চারা বিক্রি করে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তার ওখানে আসে চারা কিনতে।

মেয়ে পছন্দ হলেও যখন জালাল মিয়া জানতে পারে, মেয়ে কোন চাকরি করে না তখন আর সে বিয়েতে সায় দেয় না। তার ইচ্ছা সরকারি চাকরিজীবি মেয়ে দেখে ছেলেকে বিয়ে দিবেন। জাহিদের কাছে শুনেছিলেন মেয়ের ইনকাম তার ছেলের চেয়ে বেশি, তার ধারণা ছিল সে হয়তো কোন চাকরি করে তার ছেলের চেয়ে বেশি বেতনে। এই যুগে ঘরে বসে ইনকাম করা যায় জালাল মিয়া এটা বিশ্বাস করতে পারেন না।
জাহিদ কীভাবে তার বাবা কে রাজি করাবে তার পথ খুঁজতে থাকে। অনলাইনের মাধ্যমে যে চাকরির চেয়েও বেশি ইনকাম সম্ভব সে সম্পর্কে জাহিদের জ্ঞান কম হওয়ায় তার বাবাকে বুঝাতে পারে না। অবশেষে জেরিনের কাছে পরামর্শ চায়, কিভাবে তার বাবাকে রাজি করাবে। জেরিনের মাথায় একটি বুদ্ধি আসে। একটি নতুন পেজ খুলে জাহিদের বাবার উন্নত মানের খেজুর, নারিকেল ও সুপারিশ চারার প্রচার করতে থাকে দুজন মিলে। এ ব্যাপারে জাহিদকে সাহায্য করে জেরিন।
হঠাৎ প্রচুর চারার অর্ডার আসতে থাকে। অনলাইনে তার বাবার নাম্বার থাকায় তার ফোনেও কল করে চারা পাঠাতে বলে এবং বিকাশের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করতে চায়। জাহিদ এ ব্যাপারে জেরিনের সাথে পরামর্শ করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চারা পাঠিয়ে তার বাবাকে সহযোগিতা করে। বাবা খুশি হয়ে একদিন জাহিদকে জিজ্ঞেস করে এই বুদ্ধি এতদিনে কোথায় পেলে। আরও আগে থেকে শুরু করতে পারলে আমরা অনেক লাভবান হতাম। এ ব্যাপারে জেরিনের সহযোগিতার কথা সব খুলে বলে। জালাল মিয়া এখন তার ভুল বুঝতে পারে এবং জেরিনকে ছেলের বউ করে নিয়ে আসে।
নতুন বউ এর হাতের তুলশীমালার চালের পিঠা খেয়ে সবার মাঝে উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে পরে ।
