তুলশীমালা চালে মিশরীয় কুশারি
শেরপুরের তুলশীমালা চাল দিয়ে তৈরি মিশরীয়দের প্রিয় খাবার ‘কুশারি’ নিয়ে লিখছেন মীর শাহনেওয়াজ।
খিচুড়ি। চালের সাথে ডাল মেশানো ভারতীয় উপমহাদেশের এটা একটি বিশেষ খাবার। প্রায় সব বাড়িতেই এই খিচুড়ি খাওয়ার রেওয়াজটা প্রচলিত ছিল। ধারণা করা হয় বাঙলা ‘খিচুড়ি’ শব্দটি সংস্কৃত ‘খিচ্চা’ থেকে এসেছে। অঞ্চলভেদে শব্দটির তৃতীয় ব্যঞ্জনবর্ণটির উচ্চারণ ও ব্যবহারে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বাঙালি পরিমন্ডলে খিচুড়ি উচ্চারণ করা হলেও কোথাও কোথাও খিচুরি বলতে শোনা যায়। খিচুড়ি উচ্চারণে হিন্দীভাষীরা ‘ড়’ এবং উর্দুভাষীরা ‘র’ ব্যবহার করে থাকেন।

Table of Contents

বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি কেন?
বাঙালিদেরও অত্যন্ত প্রিয় এই খাবারটার উৎস কিন্তু অবিভক্ত বাঙলা নয়। সমস্ত ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়েই খিচুড়ি রান্না হয়ে আসছে। তবে বাঙলায় এর প্রবেশ ঘটে বেশ খানিকটা পরে। মধ্যযুগে (১২০০-১৮০০ সাল) লেখা ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে স্বয়ং শিব, পার্বতীকে যে রান্নাটির ফরমায়েশ করেছিলেন, তা ছিল খিচুড়ি। তাও আবার ডাবের জল দিয়ে মুগডালের খিচুড়ি। ডাল শস্যটির আদি ঠিকানা মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্য। সেখান থেকে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান দিয়ে উত্তর ভারত হয়ে বাঙলায় আসে এই ডাল।
বৃষ্টির দিনগুলিতে আমরা বাঙালিরা খিচুড়ি খেতে খুবই পছন্দ করি। কিন্তু কেন? আসলে গ্রাম বাংলায় বর্ষাকাল ছিল বড়ই বিড়ম্বনার সময়। প্রবল বর্ষায় বাজারহাট, রান্নাবান্না করা খুব অসুবিধেজনক হয়ে পড়ত। গৃহস্থবাড়ীতে তখন রান্নাঘর থাকত একটু বাইরের দিকে। সেখানে রান্না করতে গিয়ে ভিজে একসা হতে হতো। এই সময় বাড়ির গৃহিণীরা তাই চাল ও ডাল মিলিয়ে খুব দ্রুত ও ঝামেলামুক্ত ভাবে রেঁধে ফেলতেন খিচুড়ি। ঘরে আলু বা অন্য কোনও সবজি থাকলে তা চট করে খিচুড়িতে ফেলে দিতেন। এসব কারণেই বৃষ্টির দিনের সঙ্গে খিচুড়ি সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
খিচুড়ি’র বিচরণকাল
গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাস (৩৫৯ খ্রিষ্টপূর্ব – ২৮১ খ্রিষ্টপূর্ব) চালের সাথে ডাল মেশানো খাবার খুবই জনপ্রিয় ছিল বলে উল্লেখ করে গেছেন। আরেক গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস (৩৫০-২৯০ খ্রিস্টপূর্ব) ভারতীয় রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজদরবারে একসময়ে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর লেখাতেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের (৩৪০-২৯৮ খ্রিষ্টপূর্ব) রাজসভার রান্নাঘরে খিচুড়ির কথা পাওয়া যায়। যা কিনা চাণক্যও (৩৭০-২৮৩ খ্রিস্টপূর্ব) তার লেখায় উল্লেখ করে গেছেন যে, চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে চাল ও ডালের মিশ্রণে খিচুড়ি রান্না করা হতো।
১১ শতকে পারস্যের (ইরান) আল বেরুনীও (৯৭৩-১০৪৮) ভারতবর্ষ বিষয়ে তাঁর লেখা ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থে উত্তর ভারতে খিচুড়ি খুবই জনপ্রিয় খাবার বলে উল্লেখ করে গেছেন। ১৪ শতকে মরোক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা (১৩০৪-১৩৬৯) ‘কিশরি’র কথা উল্লেখ করেছেন যা চাল এবং মুগ ডাল দিয়ে প্রস্তুত করা হতো। ১৫ শতকে রুশ পর্যটক আফনাসিই নিকতিন তাঁর লেখায় দক্ষিণ ভারতে চাল-ডাল মিশিয়ে তৈরি খুবই জনপ্রিয় এই খাবারের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন।
সম্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫) শাসনামল (১৫৫৬-১৬০৫) থেকেই মূলতঃ মুঘলদের খিচুড়ি প্রীতির কথা উল্লেখ হতে থাকে। আকবরের মন্ত্রী ও সুলেখক আবুল ফজল রাজকীয় রান্নাঘরে বিভিন্ন ধরনের খিচু়ড়ি রান্নার কথা তাঁর লেখা ‘আইন-ই-আকবরি’তে লিখে গেছেন।
খিচুড়ির প্রতি ভালো লাগা ছিল সম্রাট জাহাঙ্গীরেরও (১৫৬৯-১৬২৭)। জাহাঙ্গীরের শাসনামলে (১৬০৫-১৬২৭) তাঁর প্রিয় খিচু়ড়ি ‘লাজিজান’ মুঘল রান্নাঘরে তৈরি করা হতো পেস্তা, কিসমিস দিয়ে। ১৭ শতকে সম্রাট শাহ জাহানের (১৫৯২-১৬৬৬) শাসনামলে (১৬২৮-১৬৫৮) হীরা-রত্নের ব্যবসায়ী ফরাসি বণিক ও পর্যটক জাঁ বাতিস্তে টেভারনিয়ার লিখেছেন, সে সময় ভারত উপমহাদেশের প্রায় সব বাড়িতেই নাকি খিচুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ ছিল।
১৭ শতকেই আবার মুঘল রান্নাঘরে সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬১৮-১৭০৭) শাসনামলে (১৬৫৮-১৭০৭) তাঁর প্রিয় ‘আলমগিরি খিচড়ি’ রান্না করতে গিয়ে চাল, ডালের সঙ্গে মেশানো হত বিভিন্ন প্রকার মাছ ও ডিম। ১৮ শতকে হায়দরাবাদের নিজামের রান্নাঘরেও রাজকীয় খাবার খিচুড়ির ভাঁজে ভাঁজে থাকতো সুস্বাদু মাংসের কিমা।
খিচুড়ি নিয়ে কান্ডকারখানা
‘কেডগেরি’ (Kedgeree)
১৯ শতকের ভিক্টোরিয়ান যুগে (১৮৩৭~১৯০১) দেশে ফেরৎ আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের হাত ধরে খিচুড়ি ইংল্যান্ডে পৌঁছায়। আগের রাতের বেঁচে যাওয়া ডাল ও ভাত থেকে তারা তৈরি করতো এই খিচুড়ি। যা পরেরদিন সকালে নাস্তা হিসাবে খেতো। উপাদেয় করতে, মাংস, মাছ ও ডিম দেওয়া হতো। এই খিচুড়িই পরবর্তীতে ব্রিটিশ-রসনা মিশ্রিত হয়ে জনপ্রিয় ইংলিশ ব্রেকফাস্ট ‘কেডগেরি’ (Kedgeree) হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। কেডগেরিতে থাকে মাছ, কেইন পেপার ও সেদ্ধ ডিম।
প্রতি বছর ক্রিসমাসের পরের দিন সেন্ট মেরি ম্যাগডালিন চার্চ পরিদর্শন করে স্যান্ড্রিংহাম হাউসে ক্রিসমাস উদযাপনের পর, রানী এলিজাবেথ এবং তার পরিবারের সকালের নাস্তার জন্য ‘কেডগেরি’ (Kedgeree) নামক মশলাযুক্ত একটি ডিশ সাজানো হয়, যা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন খাবার খিচুড়ি’র একটা অ্যাংলো সংস্করণ।
কেডগেরি হল মাছ, ভাত এবং সিদ্ধ ডিমের একটি কারি ম্যাশ-আপ। ‘কেডগেরি’তে মাছ হিসেবে থাকে সাধারণত টুনা বা স্যামন, সিদ্ধ চাল, পার্সলে, শক্ত সিদ্ধ ডিম, কারি পাউডার, মাখন বা ক্রিম এবং কিশমিশ। পরিবেশন করার সাথে সাথেই গরম গরম খিচুড়ি খেতে খুব সুস্বাদু হলেও, গরম এবং ঠান্ডা উভয় অবস্থায়ই ‘কেডগেরি’ কিন্তু খেতে সুস্বাদু লাগে।
কুশারি
১৯ শতকেরই মাঝামাঝি সময়ে নিম্নবিত্ত মিশরীয়দের মধ্যে ‘কোশারি’ নামে যে রান্নাটি জনপ্রিয় হয় তা ‘খিচুড়ি’রই ভিন্নরূপ বলা যেতে পারে। কোশারি তৈরী হতো তুলশীমালা চাল, ডাল, চানা, ভিনিগার, টমেটো সস, পিঁয়াজ, আদা, রসুন ইত্যাদি উপকরণ দিয়ে। এই তুলশীমালা চাল কিন্তু আমার জেলা শেরপুরে উৎপন্ন হয়। তুলশীমালা চালের সুনাম ও সমৃদ্ধি শতশত বছর আগের।
‘খিচুড়ি’ রান্না শিখতে বিদেশ ট্রেনিং
শত শত বছর ধরে বাঙালির ঘরে রান্না হয়ে আসা এই ‘খিচুড়ি’ রান্না শিখতে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাবের একটি খবর নিয়ে একসময় বাংলাদেশে সমালোচনার ঝড় বইছিল। প্রাথমিক প্রস্তাবে বাংলাদেশে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ৫০০ কর্মকর্তাকে পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল। এরপর পরিকল্পনা কমিশন সেটা সংশোধন করে দুইটি টিমে সর্বাধিক ১১ জন করে মোট ২২ জন নির্ধারণ করে দেয়। তবুও বিদেশ পাঠাতে হবে।